মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
অপরাধ করে বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও অপরাধের সাজা কারাদন্ডের পরিবর্তে দুস্থদের খাওয়ানো, সরকারি কাজে শ্রম দেওয়া সহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করার আদেশ এবং নেতিবাচক ও অসামাজিক কাজ থেকে বিরত থাকতে রায় দিয়েছেন বিজ্ঞ বিচারক।
কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত নম্বর-৫ এর বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ মঙ্গলবার ৩০ আগস্ট এ ব্যতিক্রমী রায় প্রদান করেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
২০১৭ সালের ২৯ জুন সকাল ৯ টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছরা ইউনিয়নের শীলখালী রেঞ্জের শীলখালী বন বিটের আওতাধীন উত্তর হ্নীলা মৌজার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জম্মানো চারা ও জঙ্গল কেটে জবর দখলের অপচেষ্টা করছিলেন ২ ব্যক্তি। বন বিভাগের টহল টিম খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে জবর দখলকারীদের ধৃত করার চেষ্টা করলে তারা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে চারা ও মাটি কাটার সরঞ্জাম উদ্ধার পূর্বক জব্দ করে বন বিভাগের টহল টিম।
এ ঘটনায় বন বিভাগ ২ জনকে আসামী করে ১৯২৭ সনের বন আইনের (২০০০ সালে সংশোধিত) ২৬ (১ক) ধারায় অভিযোগ এনে আদালতে মামলা দায়ের করেন। যার বন মামলা নম্বর ৩৮/২০১৭ (টেকনাফ)। মামলার আসামীরা হলো-টেকনাফ উপজেলার বাহারছরা ইউনিয়নের উত্তর শীলখালী এলাকার সৈয়দ সুলতানের পুত্র ছৈয়দুল ইসলাম এবং একই এলাকার ছালেহ আহামদের পুত্র মোহাম্মদ উল্লাহ প্রকাশ মাদু।
২০২২ সালের ৩ মার্চ মামলটি বিচারের জন্য কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নম্বর-৫ এ চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়।
আদালতের বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ মামলাটির ১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। আসামীদ্বয় আদালতে তাদের অপরাধ স্বেচ্ছায় স্বীকার করেন। মামলার অন্যান্য সকল বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ১৯২৭ সনের বন আইনের (২০০০ সালে সংশোধিত) ২৬ (১ক) ধারায় আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞ বিচারক আসাদ উদ্দিন মো: আসিফ মামলার ২ জন আসামীর প্রত্যেককে ৬ মাস করে সশ্রম কারাদন্ড, ১০ হাজার টাকা করে সরকারকে ক্ষতিপূরণ এবং ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ৩ মাস সশ্রম কারাদন্ডের রায় দেন।
কিন্তু এই সাজার পরিবর্তে মামলার প্রকৃতি, আসামীদের পূর্বাপর অপরাধ সংঘটন, আসামীদ্বয়ের বয়স ও লঘু অপরাধ বিবেচনায় শুধুমাত্র ক্ষতিপূরনের অর্থ পরিশোধ, দুঃস্থদের খাওয়ানো, গঠনমূলক কর্ম সম্পাদন ও ভাল আচরণ করার জন্য আসামীদের প্রাবেশন সাজা অর্থাৎ বিকল্প সাজার আদেশ দেন বিজ্ঞ বিচারক। যাতে আসামীরা তাদের অপরাধ বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে সংশোধন হওয়ার সুযোগ পায়।
রায়ে বিজ্ঞ বিচারকের দেওয়া প্রবেশন আদেশের শর্ত সমুহ হচ্ছে :
(১) রায় ঘোষণার তারিখ হতে পরবর্তী এক বছরের জন্য প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার ও বুধবার আসামীরা সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত ‘প্রত্যাহিক সেবামূলক কর্ম’ সম্পাদন করবেন। রায়ে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ চালানের মাধ্যমে জমা করে আদালতে চালানের কপি দাখিল করতে হবে। আসামীরা কোন অপরাধকর্মে জড়িত হবেন না। অনুরূপ অপরাধ আর করবেন না মর্মে ৩ কপি বন্ড সম্পাদন করে, বন্ডের এক কপি সংশ্লিষ্ট থানায়, এক কপি বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এবং এক কপি মামলার নথিতে দাখিল করতে হবে।
(২) আসামীদের বয়স, কর্মক্ষমতা ও প্রচলিত আইন বিবেচনায় আদালতের রায় অনুযায়ী শীলখালী রেঞ্জ কর্মকর্তার আওতাধীন শীলখালী বন বিট কর্মকর্তা তাদের জন্য কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করে তাঁর এলাকায় একজন ভিলেজার/শ্রমিক যেভাবে কাজ করেন, সেভাবে আসামীদের দিয়ে প্রত্যাহিক সেবামূলক কর্ম সম্পাদন করিয়ে নেবেন।
(৩) আসামীদ্বয় কক্সবাজার পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোনারপাড়ায় অবস্থিত সার্বজনীন শ্রী শ্রী কৃষ্ণানন্দধাম মন্দিরে যৌথভাবে ১০০ জন দুঃস্থকে এক বেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবেন। মন্দিরে দুঃস্থদের খাওয়ানোর পর প্রবেশন কর্মকর্তা এ বিষয়ে আগামী ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেবেন।
(৪) আসামীরা সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন এবং ভাল আচরণ ও ভাল ব্যবহার করবেন।
(৫) বিচারক/আদালত, আইনশৃংখলা বাহিনী কর্তৃক তলব করা হলে তদানুসারে উপস্থিত হতে আসামীরা বাধ্য থাকবেন।
(৬) আসামীরা কোন প্রকার মাদকদ্রব্য/নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করবেন না।
(৭) টেকনাফের প্রবেশন কর্মকর্তা আসামীদ্বয়ের নিয়মিতভাবে প্রবেশন তত্বাবধান ও পর্যবেক্ষন করবেন। প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর ধার্য তারিখে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
(৮) আসামীরা কোন শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে, শর্ত ভঙ্গ করলে বা আসামীদের আচরণ সন্তোষজনক না হলে প্রবেশন বাতিল বলে গণ্য হবে। অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আবার আসামীরা প্রবেশনকালীন সময়ে সন্তোষজনকভাবে শর্ত পালন করলে এই দন্ড ভবিষ্যতে জীবনের কোন পর্যায়ে আসামীর অযোগ্যতা বলে গণ্য হবেনা।
(৯) কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য, বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন আহমদ আসামীদের রায়ের মর্ম বুঝিয়ে দেবেন। উক্ত আইনজীবী প্রবেশন কর্মকর্তার কাছে ৪ সেপ্টেম্বর আসামীদের হাজির করবেন। প্রবেশন আদেশে এছাড়াও আরো কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে।
প্রবেশনের বিষয় অবহিত করার জন্য বিজ্ঞ বিচারকের আদেশের কপি কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও, কক্সবাজারের সমাজসেবা বিভাগের উপপরিচালক, টেকনাফের শীলখালীর রেঞ্জ অফিসার এবং প্রবেশন কার্যকর করার জন্য আদেশের কপি কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, টেকনাফ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা, টেকনাফ থানার ওসি এবং সার্বজনীন শ্রী শ্রী কৃষ্ণানন্দধাম মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আসামীদের শাস্তির পরিবর্তে প্রবেশন দেওয়ার বিষয়ে সার্বজনীন শ্রী শ্রী কৃষ্ণানন্দধাম মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি দুলাল চন্দ্র দে বলেন, এ রায় একটি অনুসরণযোগ্য ও প্রশংসনীয় রায়। এ রায়ে মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, লঘু অপরাধের জন্য শুধু শাস্তি ভোগ নয়, আইনানুগভাবে গঠনমূলক ও ইতিবাচক কর্ম করেও সঠিক ও যথার্থ বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। এ রায়ে বিজ্ঞ বিচারকের মানবিক ও অসাধারণ বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ ঘটেছে। যা সমাজে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী দুলাল চন্দ্র দে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।